বিনয়পিটকে পাচিত্তিয়া
অনুবাদক : করুণাবংশ ভিক্ষু
প্রথম পর্ব
১. মিথ্যাবাক্য বর্গ
১. মিথ্যাবাক্য শিক্ষাপদ
হে আয়ুষ্মানগণ, এখন বিরানব্বইটি পাচিত্তিয় ধর্ম উদ্দেস (আবৃত্তি) আগত হচ্ছে :
১. সে সময়ে বুদ্ধ ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের জেতবন আরামে অবস্থান করছিলেন। তখন অত্যন্ত কলহকারী ও বাদ-বিবাদকারী হত্থক নামক এক শাক্যপুত্র ছিল। সে অন্যতীর্থিয়দের সঙ্গে আলাপকালে অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলে দোষ স্বীকার করত, দোষ স্বীকার করে পুনরায় অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলত, অন্যের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেত, সজ্ঞানে বা জেনেশুনে মিথ্যা ভাষণ করত এবং সংকেত করে মিথ্যা প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা করত। তাই অন্যতীর্থিয়রা এই বলে নিন্দা, আন্দোলন এবং প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগলেন, “কেন হত্থক শাক্যপুত্র আমাদের সঙ্গে আলাপকালে অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলে দোষ স্বীকার করবেন? দোষ স্বীকার করে কেন পুনরায় অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলবেন? অন্যের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবেন, সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করবেন এবং সংকেত করে মিথ্যা প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা করবেন?” ভিক্ষুগণ সেই অন্যতীর্থিয়দের নিন্দা, আন্দোলন এবং ক্ষোভের কথা শুনতে পেলেন। তৎপর সেই ভিক্ষুগণ যথায় হত্থক শাক্যপুত্র তথায় উপস্থিত হলেন। উপস্থিত হয়ে হত্থক শাক্যপুত্রকে এভাবে বললেন, “আবুসো হত্থক, এটি কি সত্য যে, তুমি নাকি অন্যতীর্থিয়দের সঙ্গে আলাপকালে অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলে দোষ স্বীকার করো; দোষ স্বীকার করে পুনরায় অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলো; অন্যের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাও, সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করো এবং সংকেত করে মিথ্যা প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা করো?” “আবুসো, এতে কোনো কোনো অন্যতীর্থিয় জয়ী হতে পারে; এভাবে তাঁদের জয়ী হতে দেওয়া উচিত নয়।” যে সকল ভিক্ষু অল্পেচ্ছু, সন্তুষ্ট, সলজ্জ, সসঙ্কোচ ও শিক্ষাকামী, তাঁরা এই বলে আন্দোলন, নিন্দা এবং প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগলেন, “কেন হত্থক শাক্যপুত্র অন্যতীর্থিয়দের সঙ্গে আলাপকালে অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলে দোষ স্বীকার করবেন, দোষ স্বীকার করে পুনরায় অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলবেন, অন্যের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবেন, সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করবেন এবং সংকেত করে মিথ্যা প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা করবেন। অনন্তর ভগবান এই নিদানে এই প্রকরণে ভিক্ষুসংঘকে সমবেত করিয়ে হত্থক শাক্যপুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে হত্থক, এটি কি সত্য যে, তুমি নাকি অন্যতীর্থিয়দের সঙ্গে আলাপকালে অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলে দোষ স্বীকার করছ, দোষ স্বীকার করে পুনরায় অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলো, অন্যের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাও, সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করো এবং সংকেত করে মিথ্যা প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা করো?’ “হ্যাঁ ভগবান, তা সত্য বটে।” বুদ্ধ ভগবান এতে অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, মোঘপুরুষ, কী হেতু তুমি অন্যতীর্থিয়দের সঙ্গে আলাপকালে অবজ্ঞা-ঘৃণামূলক কথা বলে দোষ স্বীকার করবে, দোষ স্বীকার করে পুনরায় অবজ্ঞা ঘৃণামূলক কথা বলবে, অন্যের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবে, সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করবে এবং সংকেত করে মিথ্যা প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা করবে? এমন আচরণ কিছুতেই অপ্রসন্নদের প্রসন্নতা উৎপাদন এবং প্রসন্নদের প্রসন্নতা বৃদ্ধির সহায়ক নয়; অধিকন্তু অপ্রসন্নদের অপ্রসন্নতা বৃদ্ধি এবং কোনো কোনো প্রসন্নদের অপ্রসন্নতা উৎপত্তির কারণ হবে। তদ্ধেতু হে ভিক্ষুগণ, আমি এই শিক্ষাপদ উদ্দেস করছি:
২. যেকোনো ভিক্ষু সজ্ঞানে বা জেনেশুনে মিথ্যা ভাষণ করলে, তার পাচিত্তিয় অপরাধ হয়।
৩. সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ হচ্ছে, কোনো এক ব্যক্তির বিশ্বাস স্থাপনের নিমিত্ত মিথ্যাবাদিতামূলক এক ধরনের বাক্য প্রকাশভঙ্গি বা উচ্চারণভঙ্গি, যা বাচনিকভাবে অষ্ট অনার্য বা হীন বাক্য; যথা: (১) অদৃষ্টকে দৃষ্ট বলা; (২) অশ্রুতকে শ্রুত বলা; (৩) অঘ্রাণিতকে ঘ্রাণিত, অনাস্বাদিতকে আস্বাদিত ও অস্পৃষ্টকে স্পৃষ্ট বলা; (৪) অজ্ঞাতকে জ্ঞাত বলা; (৫) দৃষ্টকে অদৃষ্ট বলা; (৬) শ্রুতকে অশ্রুত বলা; (৭) ঘ্রাণিতকে অঘ্রাণিত, আস্বাদিতকে অনাস্বাদিত ও স্পৃষ্ট কেই অস্পৃষ্টয় বলা; এবং (৮) জ্ঞাত কেই অজ্ঞাত বলা। এই স্থলে অদৃষ্ট হচ্ছে, চক্ষু দ্বারাই অদৃষ্ট; অশ্রুত হচ্ছে, কর্ণ দ্বারাই অশ্রুত; অঘ্রাণিত হচ্ছে, নাসিকা দ্বারাই অঘ্রাণিত; অনাস্বাদিত হচ্ছে, জিহ্বা দ্বারাই অনাস্বাদিত; অস্পৃষ্ট হচ্ছে, কায় দ্বারাই অস্পৃষ্ট; অজ্ঞাত হচ্ছে, মন বা চিত্ত দ্বারাই অজ্ঞাত; দৃষ্ট হচ্ছে, চক্ষু দ্বারাই দৃষ্ট; শ্রুত হচ্ছে, কর্ণ দ্বারাই শ্রুত; ঘ্রাণিত হচ্ছে, নাসিকা দ্বারাই ঘ্রাণিত; আস্বাদিত হচ্ছে, জিহ্বা দ্বারাই আস্বাদিত; স্পৃষ্ট হচ্ছে কায় দ্বারাই স্পৃষ্ট; জ্ঞাত হচ্ছে, মন বা চিত্ত দ্বারাই জ্ঞাত।
৪. তিন প্রকারে ‘অদৃষ্টকে দৃষ্ট’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়; যথা : (১) মিথ্যা বলার পূর্বে সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলতে যাচ্ছি’, (২) মিথ্যা বলার সময় সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলছি’, (৩) মিথ্যা বলার পর সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলেছি’। চার প্রকারে ‘অদৃষ্টকে দৃষ্ট’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়; যথা : (১) মিথ্যা বলার পূর্বে সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলতে যাচ্ছি’, (২) মিথ্যা বলার সময় সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলছি’, (৩) মিথ্যা বলার পর সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলেছি’, (৪) অমূলক বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে। পাঁচ প্রকারে ‘অদৃষ্টকে দৃষ্ট’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়; যথা : (১) মিথ্যা বলার পূর্বে সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলতে যাচ্ছি’, (২) মিথ্যা বলার সময় সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলছি’, (৩) মিথ্যা বলার পর সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলেছি’, (৪) অমূলক বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে; (৫) অমূলক ধারণার বশবর্তী হয়ে। ছয় প্রকারে ‘অদৃষ্টকে দৃষ্ট’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়; যথা : (১) মিথ্যা বলার পূর্বে সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলতে যাচ্ছি’, (২) মিথ্যা বলার সময় সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলছি’, (৩) মিথ্যা বলার পর সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলেছি’, (৪) অমূলক বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে; (৫) অমূলক ধারণার বশবর্তী হয়ে; (৬) মিথ্যা অভিলাষের বশবর্তী হয়ে। সাত প্রকারে ‘অদৃষ্টকে দৃষ্ট’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়; যথা : (১) মিথ্যা বলার পূর্বে সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলতে যাচ্ছি’, (২) মিথ্যা বলার সময় সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলছি’, (৩) মিথ্যা বলার পর সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলেছি’, (৪) অমূলক বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে; (৫) অমূলক ধারণার বশবর্তী হয়ে; (৬) মিথ্যা অভিলাষের বশবর্তী হয়ে; (৭) অসৎ উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে।
৫. তিন প্রকারে ‘অশ্রুতকে শ্রুত’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়। ‘অঘ্রাণিতকে ঘ্রাণিত’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়। ‘অনাস্বাদিতকে আস্বাদিত’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়। ‘অস্পৃষ্টকে স্পৃষ্ট’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়। ‘অজ্ঞাতকে জ্ঞাত’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়; যথা : (১) মিথ্যা বলার পূর্বে সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলতে যাচ্ছি’, (২) মিথ্যা বলার সময় সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলছি’, (৩) মিথ্যা বলার পর সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলেছি’। চার প্রকারে...পাঁচ প্রকারে...ছয় প্রকারে...সাত প্রকারে ‘অজ্ঞাতকে জ্ঞাত’ বলে সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণ করলে, পাচিত্তিয় অপরাধ হয়; যথা : (১) মিথ্যা বলার পূর্বে সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলতে যাচ্ছি’, (২) মিথ্যা বলার সময় সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলছি’, (৩) মিথ্যা বলার পর সে জানে যে, ‘আমি মিথ্যা বলেছি’, (৪) অমূলক বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে; (৫) অমূলক ধারণার বশবর্তী হয়ে; (৬) মিথ্যা অভিলাষের বশবর্তী হয়ে; (৭) অসৎ উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে।