ছোটবেলায় দিনগুলো, এইটুকুন বাচ্ছাছেলের কী বুদ্ধি, (বন ভান্তের জীবনী)


বন ভান্তের জীবনী

ছোটবেলায় দিনগুলো

 লেখক: ইন্দ্রগুপ্ত ভিক্ষু

পুণ্যবান ও ধর্মপ্রাণ দম্পতির শিশু রথীন্দ্র শুক্লপক্ষের চন্দ্রের মতো দিন দিন বড় হতে থাকলেন। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সৌষ্ঠবও বৃদ্ধি পেতে থাকল। মায়ের কোল বসে হাত নাড়েন, পা ছোড়েন। হাতের কাছে যা পান কচিমুখে দেন, পিক করে হাসেন। সেই সহাস্য পবিত্র মুখ দেখে মুগ্ধ বিমোহিত হন পিতা-মাতা, পরিবার পরিজনও। মাঝে মাঝে শিশুর গম্ভীরভাব দর্শনে বিস্মিতও হন তারা। পরিবারের সদস্যরা যে-পায় সে তাকে কোলে তুলে নেন, চুমো দেন, আদর-সোহাগ করেন। একটু বেড়ায়ে আনেন। এতে শিশু বেশ আনন্দ পায়। শিশু রথীন্দ্র যখন হাঁটি-হাঁটি পা পা করেন, এক-আধটু কথা বলতে শিখেন, তখন থেকেই তাঁর স্বভাবে ভিন্ন প্রকৃতি ধরা পড়তে থাকল। বহুজন্ম হতে আচরিত বৈরাগ্যভাবের ফলে খুব ছোটবেলা থেকে সবকিছুর প্রতি তাঁর কেমন যেন উড়ু উড়ু ভাব। পাড়া-প্রতিবেশীর অন্যান্য বালক যখন দৌঁড়াদৌঁড়ি, নানাবিধ খেলা করে আনন্দে মত্ত, তখন বালক রথীন্দ্র থাকেন চুপচাপ, গম্ভীর, ভাবুক, আনমনা হয়ে। তাঁর চাল-চলন একবারে ভিন্ন প্রকৃতির। বালকসুলভ চঞ্চলতা, দুষ্টামি করা নেই বললেই চলে। প্রায়সময়ই একাকী থাকেন। অন্যান্য বালক-বালিকাদের সাথে মিশেন না তেমন। নির্জনস্থানে থাকতেই তাঁর পছন্দ। সর্বদা যেন কিসের (বৈরাগ্যে?) চিন্তায় তন্ময় থাকেন। যাকে বলে মর্নিং শোজ দ্য ডে-এ আলামত দেখা যেতে থাকল। পরবর্তীতে তাঁর সেই বাল্যকালের কথা বলতে গিয়ে তিনি আমাদের কে দেশনাই ফাঁকে বলতেন, মাত্র চার কি পাঁচ বছর বয়সেই আমি যখন নির্জন স্থানে চুপচাপ বসেয় চোখ বন্ধ করে থাক তাম, তখন এক উজ্জ্বল আলোয় (আলোক নিমিত্ত) দেখতে পেতাম। সেই আলোয় আমার চারপাশ আলোকিত করতো। একসময় আবার পট করে নিভে যেতো। সেভাবে কখনো জ্বলে উঠতো আর কখনো নিভে যেতো। প্রথম প্রথম সেরূপ আলো দর্শনে ভয়ার্ত হয়ে ভাবতাম, এটা কোনো খারাপ লক্ষণ নাকি? শেষ মেশ ধরেই নিই, আলো দেখা তো খারাপ কিছু হবে না। মাঝে মাঝে একাকী বিছা নায় পড়ে থাকলেও সেই আলো দেখতাম।

 

এইটুকুন বাচ্ছাছেলের কী বুদ্ধি

শিশু রথীন্দ্রের বয়স ৫ কি ৬ বছর। শীতের এক সকালে এক মোয়া-মুড়ি বিক্রেতা মোয়া-মুড়ি, মোয়া-মুড়ি রব তুলে তাঁদের বাড়ীর পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। সেই রব শুনে বীরপুদি ঘরের ভেতর থেকে আদরের পুত্রকে ডেকে উটলেন, বাবা রথী। যাও তো মোয়া মুড়ি বিক্রেতা কে ডেকে নিয়ে আসোতো। কিছু মোয়া-মুড়ি কিনেই রাখি। রথীন্দ্র বাধ্য ছেলের মতো হাসি মুখে সহসা নিজেদের উঠানে ডেকে নিয়ে আনলেন মোয়া-মুড়ি বিক্রেতা কে। বীরপুদি চাকমার দেখা দেখিতেই পাশের বাড়ীর কয়েক জন নারীও এসেই যোগ দিল। একসাথে বেশ কয়েক জন ক্রেতা পেয়ে মোয়-মুড়ি ওয়ালাও খুশি হল। দর-দাম সব ঠিকঠাক হলে মোয়া-মুড়ি ওয়ালার পাল্লায় মোয়া-মুড়ি উঠায়ে মাপ দিতেই শুরু করল। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু রথীন্দ্র বলে উঠলেন, এই মোয়া-মুড়িওয়ালা, তোমার পাল্লায় যে ফের আছে। ফের পাল্লা দিয়ে তো মেপে দিতে পার না। সেটা ঠিক করে নাও। মোয়া-মুড়িওয়ালা হতভম্ব হয়ে গেল। চোখ বড় করেই ফেলল। মনে মনে ভাবল, এতো বছরের কূট-কৌশল এই টুকুন বাচ্ছাছেলের ধরে ফেলল কী করে। বলতে গেলে সবেই মাত্র আঙুল চোষাই শেষ হয়েছে। এত্ত টুকুন ছেলের কী বুদ্ধি!। তারপরও অনেকটা কপট ঢঙে হেসে জোরগলায় বলে উঠল, না বাবা, তোমার কথা ঠিক নয়। আমি কোনোদিন ফের পাল্লায় বেচা-কেনা করি না। যদি এ রকম কাজ করি তো...। মোয়া-মুড়িওয়ালার মুখে ডাহা মিথ্যাকথা শুনে রথীন্দ্রের মনে বেশ জেদ ধরে গেল। অন্যায় কাজ করবে আর সাধু সাজবে। এবার কাছে এসে দৃঢ়বাক্যে বলে উঠলেন, তাহলে প্রমাণ দেখাও। মুখে বললে তো পাল্লার ফের দূর হবে না। আমি বলছি তোমার পাল্লাই অবশ্যই ফের আছে। রথীন্দ্রের এ কাণ্ড দেখে মা বীরপুদিও অন্যান্য নারীরা অবাক হয়ে গেলেন। অমনি তারাও মোয়া-মুড়িওয়ালা কে চাপ দিতেই লাগলেন, পাল্লার ফের পরীক্ষা করে দেখাতে হবে। আর কী উপায়! বাধ্য হয়ে মোয়া-মুড়িওয়ালা পাল্লা হতে সিল নামাল কাঁপা হাতে। এবার প্রমাণ হল, সত্যিই সত্যিই পাল্লায় ফের আছে। মুহূতেই মোয়া-মুড়িওয়ালার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মাথা হেঁট করে মাফ চেয়ে নিল বীরপুদিদের কাছেই। রথীন্দ্র এবার শান্ত, গম্ভীর গলায় বললেন, দেখছ তো তুমি মিথ্যাকথা বলেছ। মনে রাখবে মিথ্যাকথা বলা মহাপাপ, আর কাউকে ঠকালেও পাপ হয়। তুমি এ পাপ কাজ ছেড়ে দাও। তোমাকে ধরেছি বলে খারাপ লাগলো? শিশু রথীন্দ্রের মুখেই এবম্বিধ অর্থপূর্ণ উপদেশ বাক্য শুনেই মোয়া-মুড়িওয়া লার সব লজ্জা, দুঃখ নিমিষেই দূর হয়ে গেল যেন। সে অবাক বিস্ময়ে রথীন্দ্রের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ ধরে। তার পর বীরপুদি চাকমাকে বলল, আপনার এ শিশুকে ভালো ভাবে দেখে রাখবেন। এ শিশু একদিন অনেক বড় কিছু হবে। আর রথীন্দ্রের মাথাই হাত বুলায়ে ছোট্ট করে বলে উঠল, বাবা, তুমি অনেক বড়ো হও। চলে যাবার সময় মোয়া-মুড়িওয়ালা বার বার রথীন্দ্রের মুখের দিকেই তাকাতে চেষ্টা করল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন