বন ভান্তের জীবনী
বংশ পরিচয়
ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসক ক্যাপ্টেইন টমাস হার্বাট লুইন-এর রাজনৈতিক কূটকৌশলের শিকার হয়ে চাকমা রানি কালিন্দী ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে চাকমা রাজার রাজধানী ও রাজবাড়ি রাঙামাটিতে স্থানান্তরিত করেন। কিন্তু তিনি তাঁর জীবদ্দশায় নবসৃষ্ট রাজধানী রাঙামাটিতে আসেননি। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরে অবস্থান করেন। ইতিপূর্বে ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে জেলা হেড কোয়াটার চন্দ্রঘোনা হতে রাঙামাটিতে স্থানান্তরিত হবার পর থেকে চাকমা রাজার প্রজারা আর চট্টগ্রামের সমতল এলাকায় বসবাসে আগ্রহ দেখায়নি। তারা নব প্রতিষ্ঠিত জেলা সদর ও রাজধানীর আশেপাশে যার যায় গোষ্ঠি সর্দারের সাথে আত্মীয়-পরিজন নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। অবশ্য বেশ কিছু সংখ্যক লোকজন রাঙামাটি সদর হতে বেশ দূরে নতুন জমির সন্ধানে চেঙ্গী, কাচালং, সুবলং, বরকল, মাইনী উপনদী উপত্যকায় বসতি গড়ে তোলেন।
রাঙামাটি শহরের নীচে মগবান, বড়াদাম, গোলাছড়ি, বালুখালি, কামিলাছড়ি ইত্যাদি স্থানে ধামাই গোজার লোকজন বাস করতে থাকলেন। ধনপাতা, কুশল্যাঘোনা, জীবতলি, কাংড়াছড়ি ইত্যাদি স্থানে কাম্ভে গোজার লোক বাস করতে থাকলেন। রাঙ্গাপানি, কাটাছড়ি, মানিকছড়ি, তৈমিদুং ইত্যাদি স্থানে কুড়াকুট্যা গোজার লোকজন বাস করতে থাকলেন। হাজারীবাক, বন্দুকভাঙ্গা ইত্যাদি স্থানে বর্বুয়া গোজার লোকজন বাস করতে থাকলেন। লার্মা, বাবুরা, মুলিমা, রাঙে, বংশা (ওয়াংজা), তৈন্যা, লেবা, চেগে, ফাকসা গোজার লোকজন চেঙ্গী, কাচালং ও সুবলং এলাকায় বাস করতে থাকলেন। কাজেই মগবান মৌজাধীন মোরঘোনা নিবাসী হারুমোহন চাকমা যে ধামাই গোজার লোক এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। চাকমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সন্তান-সন্ততিগণ বাপের বংশের (গোত্রের) পরিচয়ে পরিচিত হয়ে থাকেন। চাকমাদের এই গোজাগত পরিচয়ে রথীন্দ্র লাল চাকমা ধামাই গোজার পিড়াভাঙ্গা গোত্র পরিবাবের সন্তান। বড়াদাম মৌজার স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ত্রিলোচন দেওয়ান ও তৎপুত্রগণ যারা চাকমা রাজা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, তারাও ধামাই গোজার পিড়াভাঙ্গা গোষ্ঠির লোক। ত্রিলোচন দেওয়ানের সুযোগ্য পুত্র ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার আমলের এম.এল.এ. কামিনী মোহন দেওয়ান তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “পার্বত্য চট্টগ্রামের দীন সেবকের জীবন কাহিনী” এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘পিতৃদেব ত্রিলোচন দেওয়ান ও পীড়াভাঙ্গা গোষ্ঠী’র সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত লেখেছেন। সেখানে তিনি লেখেছেন, “চাকমা জাতির ইতিবৃত্তে যে পাগলা রাজা ১৬৩৮ খ্রি. তদীয় প্রজাগণ কর্তৃক নিহত হন, তদীয় রাণী রাজকুমারী অমঙ্গলীকে লইয়া আত্মরক্ষার্থে ত্রিপুরারাজ্যে পলায়ন করিয়া কুর্ত্তাজ্যা নামক ত্রিপুরার এক সম্ভ্রান্ত লোকের সহিত বিবাহ দেওয়ার পর রাজকুমারীর গর্ভে যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় তিনি পীড়াভাঙ্গা নামে অভিহিত হন। এ পীড়াভাঙ্গা বংশজ গুজা ও মেজা দুই ভ্রাতা হইতে ধারাবাহিকরূপে ঐ বংশের অর্থাৎ আদিপুরুষ পীড়াভাঙ্গা নামেই আমাদের বংশের নাম আখ্যাত হইয়া চলিয়া আসিতেছে।
অপর একটি গোজার নাম উল্লেখ না করলে রথীন্দ্র
লাল চাকমা বংশের পরিচয় খানিকটা অসমস্তই থেকে যায়। সেই গোজার নামটি হল কাম্ভে গোজা।
রথীন্দ্রের মাতা বীরপুদি চাকমা কাম্ভে গোজার থেয়্যা গোষ্ঠির লোক। তাঁর পিতা রয়চন্দ্র
চাকমা রেইংখ্যং কাংড়াছড়ি মৌজার অধিবাসী। বীরপুদি চাকমার মায়ের নাম হল ছরবী চাকমা। বীরপুদিরা
৫ ভাই ২ বোন। যথাক্রমে : ১) মন্দাদরী চাকমা ২) দিনমনি চাকমা ৩) ভীষ্মমুনি চাকমা ৪)
বীরবাহু চাকমা ৫) বীরপুদি চাকমা ৬) তরনী চাকমা ৭) কালি চাকমা। ভাইদের মধ্যে বীরবাহু
চাকমা ধনাঢ্য ব্যক্তি। তাঁর প্রচুর জমি-জমা রয়েছে, রয়েছে গাছ ও বাঁশের ব্যবসাও। তিনি
গভীর বন থেকে হাতি দিয়ে গাছ টানেন। আর বাঁশ ব্যবসাও বেশ লাভজনক। বোনদের মধ্যে মন্দাদরী
চাকমার স্বামী হলেন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ভগবান চন্দ্র দেওয়ান। এই ভগবান চন্দ্র দেওয়ান
হলেন চাকমা রাজা হরিশ্চন্দ্রের বৈমাত্রের ভাই। এসব বংশানুক্রমিক সম্পর্ক থেকে বলা যায়
রথীন্দ্র লাল চাকমার পিতৃকুল ও মাতৃকুলের সাথে চাকমা রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।