বন ভান্তের জীবনী
লেখক:
শ্রীমৎ ইন্দ্রগুপ্ত ভিক্ষু
জন্ম ও জনপদ
নীলাভা জলরাশির অধিকারিনী কর্ণফুলী (এ কর্ণফুলীকে চাকমারা বলেন ‘বরগাং’ অর্থাৎ বড়নদী) নদীর তীরঘেঁষে, পার্বত্যের সবুজ-শ্যামল বনরাজি ঘেরা রাঙামাটি শহর। শহরের প্রায় ৬ মাইল অদূরে ১১৫নং মগবান মৌজাধীন ছোট একটি চাকমা পল্লীগ্রামের নাম “মোরঘোনা”। সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা ধান, গোয়ালভরা গো-মহিষ, ক্ষেত্রভরা ফসল আর সবুজ বনানী, গাছপালা ঘেরা স্নিগ্ধ-সুন্দর একটি গ্রাম এটি। গ্রামের পশ্চিমপার ঘেঁষে কর্ণফুলী নদী কল কল রবে বয়ে চলছে আপন গন্তব্যে-সমুদ্রপানে। এ কর্ণফুলী নদী চাকমাদের জীবন প্রবাহকে করেছে গতিময়। নদীর অববাহিকায় উর্বর সমতলভূমি, উভয়পারে গভীর অরণ্য যুগ যুগ ধরে আকর্ষণ করেছে চাকমা জনগোষ্ঠিকে। এই কর্ণফুলী বিধৌত পার্বত্য ভূমিকে বৃট্রিশরা চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল বলতেন। পরে ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা জেলায় ভাগ করে উপজাতীয়দের সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়-বৃট্রিশ সরকার কর্তৃক। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠনের অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলে চাকমারা বসবাস করতেন। ঐতিহাসিক বুকানন ১৭৯৮ সালে তাঁর লিখিত বিখ্যাত এই অঞ্চলে চাকমাদের বসতি দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। সেই হিসেবে সুদীর্ঘকাল যাবত হতে চাকমারা এ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছেন। চাকমারা এ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা। তবে হ্যাঁ, চাকমাদের সাথে আরও অন্যান্য আদীবাসীদেরও বাস রয়েছে এখানে।
মোরঘোনা নামক এই ছোট গ্রামটি চাকমা জাতির অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তি ত্রিলোচন দেওয়ানেরই শাসিত। অর্থাৎ এ গ্রামটি যে মৌজায় অবস্থিত, সেই মৌজার হেডম্যান ত্রিলোচন দেওয়ান। পরে তারই সুযোগ্য পুত্র বাবু বিরাজ মোহন দেওয়ান হেডম্যান নিযুক্ত হন। মোরঘোনা গ্রামটি কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পারে। গ্রামের পূর্বপার্শ্বে সামান্য উচু পাহাড়, এর সমতলে আড়াআড়িভাবে ধানক্ষেত। পশ্চিমপার্শ্বে বা কর্ণফুলী নদীরপারে রবিশস্যের জন্য উচুভূমি। গ্রামবাসী প্রায় সবাই ভূ-সম্পত্তির মালিক ও স্বচ্ছল গৃহস্থ। গ্রামের ঠিক পশ্চিমদিকে নদীর ঐ পারে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে নাকসছড়ি কিচিং (যেই কিচিং-টি এখনো বিদ্যমান রয়েছে, জলমগ্ন হয়নি)। সেই নাকসছড়ি কিচিং বরাবর একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়ি। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়ী হলেও বাড়ীটি বেশ বড়োসড়ো। গৃহর্কতার নাম হল হংসমুনি চাকমা। শ্রী চাকমার সংসার মধ্যবিত্ত হলেও অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্য বলতে কিছুই নেই। নিজের উৎপাদিত ফসলে অনায়াসে কেটে যায় পুরোটি বছর। কৃষিকাজ বা চাষবাস করে জীবিকা-নির্বাহ করেন তিনি। তাঁর ৬ ছেলে ৩ মেয়ে মিলে বেশ বড়ো পরিবার। ছেলেরা হলেন ১) হারুমোহন চাকমা (হারবো) ২) রত্নমোহন চাকমা ৩) গুম্যা চাকমা ৪) কান্দারা চাকমা ৫) কুঞ্জ চাকমা ৬) সুরেন্দ্রলাল চাকমা। মেয়েরা হলেন ১) এলংবি চাকমা, ২) বিন্দি চাকমা, ৩) যম মা (আসল না পাওয়া সম্ভব হয়নি)। গৃহর্কতা বহুবছর পর্যন্ত সবছেলেকে সঙ্গে নিয়ে একই বাড়ীতে থাকলেন। বড়ছেলে বিবাহ উপযুক্ত হলে বীরপুদি চাকমা নাম্নী এক সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়েকে পুত্রবধূরূপে ঘরে এনে পিতৃ কর্তব্য সম্পাদন করলেন । বীরপুদি চাকমার ডাক নাম হল মিলি। এভাবে হারুমোহন চাকমার সাংসারিক জীবন শুরু হল। আর স্ত্রী বীরপুদি চাকমাকে নিয়ে বেশ আনন্দ দিন কাটাতে লাগলেন। তবে প্রথমদিকে অপুত্রক থাকলেন এই দম্পতি। পুত্রধনে বঞ্চিত অবস্থায় কয়েক বছর অতিবাহিত করার পর বীরপুদি চাকমা অবশেষে অনত্মঃসত্ত্বা হলেন। সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে হারুমোহন চাকমার অন্তর এবার আনন্দে নেচে উঠল। আনন্দে উদ্বেলিত হল বীরপুদি চাকমার মন-প্রাণও। যথাসময়ে বীরপুদি চাকমা সুপ্রসব করলেন এক পুত্ররত্ন। সালটা ১৯২০, ৮ই জানুয়ারি, রোজ বৃহস্পতিবার। সেদিনও প্রকৃতির নিত্যকার নিয়মে পূর্বদিগন্তে উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটার জ্যোতিতে উদয় হলো রবি। কিন্তু কেউ কি ভাবতে পারলেন যে, এ দিনটি অন্যান্য দিনের মতন একটা দিন নয়। এই দিনটিতে ঘটে গেল এক বিরল ব্যতিক্রমী কাহিনী (ঘটনা)। দিনটি হয়ে গেল অনন্য ইতিহাসে ভরা এক শুভমুহূর্ত, এক শুভক্ষণ। বৃহত্তর পার্বত্য অঞ্চল তথা বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে উদিত হল এক অতি উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি হয়ে উঠবেন সর্বজন পূজ্য শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভন্তে) নামে এক নন্দিত শ্রাবকবুদ্ধ। যিনি হবেন ভিক্ষুকুল গৌরব, সদ্ধর্মের ধ্বজাধারী, সদ্ধর্ম জ্ঞানতিলক, সদ্ধর্ম জাগৃতির দিকপাল ও প্রকৃত বৌদ্ধকুলপুত্র শ্রেষ্ঠ মহামানব। ঠিক এমনি আমেজে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে নীলাভা জলরাশির অধিকারিণী কর্ণফুলী নদীর তীরঘেঁষা “মোরঘোনা” গ্রামে হারুমোহন চাকমার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেন একটি ফুট্ফুটে পুত্রসন্তান। নবজাতকের নামকরণ করা হলো রথীন্দ্র লাল চাকমা। পিতা-মাতার একান্তকাম্য বহু প্রতীক্ষার ফল পুত্রসন্তান লাভ করে তারা হলেন পরমানন্দিত। নবজাত শিশুর কোমল বদন দর্শনে উৎফুল্ল হল তাদের মনপ্রাণ।