মহানির্দেশ খুদ্দকনিকায়ে
অনুবাদকমণ্ডলী : শ্রীমৎ ইন্দ্রগুপ্ত ভিক্ষু, বঙ্গীস ভিক্ষু,
অজিত ভিক্ষু ও সীবক ভিক্ষু
১. অষ্টক-বর্গ
১. কাম সূত্র বর্ণনা
১. কামভোগ প্রার্থনাকারীর কামনা (বস্তুকাম)
পূর্ণ হলে, মানুষ ঈপ্সিত বিষয় (পঞ্চকামগুণ) লাভ করলে অবশ্যই তার মন প্রীত হয়।
“কাম” বলতে বিভাগ অনুযায়ী কাম দুই প্রকার; যথা: বস্তুকাম ও ক্লেশকাম। বস্তুকাম
কিরূপ? মনোজ্ঞ রূপ, মনোজ্ঞ শব্দ, মনোজ্ঞ গন্ধ, মনোজ্ঞ রস, মনোজ্ঞ স্পর্শ; আস্তরণ (কার্পেটাদি),
আবরণ (পরিচ্ছদ), দাসদাসী, ছাগল, ভেড়া, কুক্কুট, শূকর, হস্তি, ষাঁড়, অশ্ব, ঘোটকী, ক্ষেত্র,
বস্তু, হিরণ্য, সুবর্ণ, গ্রাম, নিগম, রাজধানী, রাষ্ট্র, জনপদ, কোষাগার, ভাণ্ডাগার এবং
যেসব মনোরম বা কামোদ্দীপক বস্তু, এসবই বস্তুকাম (বৈষয়িক ইচ্ছা)।
অধিকন্তু, অতীত কাম, অনাগত কাম, বর্তমান কাম, অধ্যাত্ম কাম, বাহ্যিক কাম, অধ্যাত্ম-বাহ্যিক কাম; হীন (স্বল্প) কাম, মাঝারি কাম, প্রণীত (উত্তম) কাম; নারকীয় কাম, মানবীয় কাম, দিব্য কাম, প্রত্যুৎপন্ন কাম; নির্মিত কাম, অনির্মিত কাম, পরনির্মিত কাম, পরিগৃহীত কাম, অপরিগৃহীত কাম, মমায়িত কাম, অমমায়িত কাম; সকল কামাবচর ধর্ম, সকল রূপাবচর ধর্ম, সকল অরূপাবচর ধর্ম, কামনীয়, রজনীয় (আনন্দবর্ধনকারী), মত্ততাজনক, তৃষ্ণাবস্তুক (তৃষ্ণামূলক) ও তৃষ্ণালম্বন কাম, এগুলোকে বস্তুকাম বলা হয়।
ক্লেশকাম কিরূপ? ছন্দ (ইচ্ছা) কাম, রাগ (আসক্তি) কাম, ছন্দরাগ কাম; সংকল্প কাম (কামেচ্ছা), রাগ কাম, সংকল্পরাগ কাম (রাগেচ্ছা কাম); যা কামসমূহে কামচ্ছন্দ, কামরাগ, কামনন্দী, কামতৃষ্ণা, কামস্নেহ, কাম-পরিলাহ, কাম-বিহ্বলতা, কামাসক্তি, কামোঘো, কামযোগ, কামোপাদান এবং কামচ্ছন্দ-নীবরণ। (আমি) কামের মূল দেখেছি। সংকল্প হতেই কাম উৎপন্ন হয়। আমি তা সংকল্প বা ইচ্ছা করব না, এরূপে কাম উৎপন্ন হবে না।
এগুলোকে ক্লেশকাম বলা হয়। “প্রার্থনাকারীর” (কামযমানস্স) বলতে কামনাকারীর, ইচ্ছাকারীর, অভিলাষকারীর, প্রার্থনাকারীর,
আকাঙ্ক্ষাকারীর, আরাধনাকারীর, কামভোগ প্রার্থনাকারীর। “তার” অর্থে সেই ক্ষত্রিয়ের, ব্রাহ্মণের, বৈশ্যের, শূদ্রের, গৃহস্থের,
প্রব্রজিতের, দেবের বা মনুষ্যের। “তা” বলতে বস্তুকামকে বুঝানো হচ্ছে : মনোজ্ঞ রূপ, মনোজ্ঞ শব্দ, মনোজ্ঞ গন্ধ,
মনোজ্ঞ রস, মনোজ্ঞ স্পর্শ। “পূর্ণ হয়” অর্থে ফলবতী হওয়া, সিদ্ধ হওয়া, লাভ করা, প্রতিলাভ করা, অর্জন করা এবং
অনুভব (বা উপার্জন) করা। এ অর্থে তার বস্তুকাম লাভ হয়।
“অবশ্যই” (অদ্ধা) বলতে নির্দিষ্ট বচন, সংশয়শূন্য বচন, নিঃশঙ্ক বচন, সন্দেহহীন
বচন, বিশ্বস্ত বচন, সুনিশ্চিত বচন, সত্যবচন, ব্যর্থহীন বচন—অবশ্যই (অদ্ধা)। “প্রীতি” (পীতি) অর্থে যা পঞ্চকামগুণ প্রতিসংযুক্ত আনন্দ, আমোদনা, প্রমোদনা,
হাস্য, প্রহাস্য, বিত্তি (উল্লাস), তুষ্টি, পরমাহ্লাদ, আনন্দপূর্ণ মনোবৃত্তি ও চিত্তের
অভিস্ফুরণ প্রীতি। “মন” (মনো) বলতে যা চিত্ত, মন, মানস, হৃদয়, পাণ্ডুর, মনায়তন, মনেন্দ্রিয়,
বিজ্ঞান, বিজ্ঞানস্কন্ধ, তদুদ্ভূত মনোবিজ্ঞানধাতু, একে মন বলা হয়। এ মন এ প্রীতির সাথে
সহগত, সহজাত, সংশ্লিষ্ট, সম্প্রযুক্ত, একোৎপাদ, একনিরোধ, একবস্তুক ও একালম্বন হয়। “প্রীতিমনা হয়” (পীতিমনো
হোতি) অর্থে প্রীতিমনা, তুষ্টমনা, হৃষ্টমনা, প্রহৃষ্টমনা, আনন্দমনা, উৎফুল্লমনা, মুদিতমনা
(প্রফুল্লমনা) ও প্রসন্নমনা হওয়া। এ অর্থে অবশ্যই প্রীতিমনা হয়।
“লাভ করে” (লদ্ধা) বলতে লাভ করে, প্রতিলাভ করে, অর্জন করে, উপার্জন করে। “মানুষ” (মচ্চো) অর্থে সত্ত্ব, নর, মানব, পুরুষ, পুদ্গল, জীব, ব্যক্তি,
প্রাণী, লোক, মনুষ্য। “যা ইচ্ছা করে” (যদিচ্ছতি)
বলতে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস বা স্পর্শ যা কামনা করে, যা অভিলাষ করে, যা প্রার্থনা করে,
যা আকাঙ্ক্ষা করে, যা অভিপ্রায় করে বুঝায়। এ অর্থে মানুষ ঈপ্সিত বিষয় লাভ করে।
তাই ভগবান বলেছেন: কামভোগ প্রার্থনাকারীর কামনা (বস্তুকাম) পূর্ণ হলে, মানুষ ঈপ্সিত বিষয়
(পঞ্চকামগুণ) লাভ করলে অবশ্যই তার মন প্রীত হয়।
২. সেই কামভোগ প্রার্থনাকারীর, কামচ্ছন্দ উৎপন্নকারী ব্যক্তির সেই কামবস্তু
বা বিষয় পরিহীন (ক্ষয়) হলে শল্যবিদ্ধ ব্যক্তির ন্যায় ব্যথিত হয়।
“তার” বলতে সেই ক্ষত্রিয়ের, ব্রাহ্মণের, বৈশ্যের, শূদ্রের, গৃহস্থের, প্রব্রজিতের,
দেবের বা মনুষ্যের। “প্রার্থনাকারীর” (কামযমানস্স)
অর্থে কাম ইচ্ছাকারীর, অভিলাষকারীর, প্রার্থনাকারীর, আকাঙ্ক্ষাকারীর, অভিপ্রায়কারীর।
অথবা কামতৃষ্ণা দ্বারা চালিত হওয়া, নীত হওয়া, পরিচালিত হওয়া, বাহিত (বা গৃহীত) হওয়া।
যেমন : হস্তিযান, অশ্বযান, গোযান, অজযান, ভেড়াযান, উটযান বা গর্দভ (গাধা) যান দ্বারা
চালিত, নীত, পরিচালিত ও বাহিত হয়; ঠিক এভাবেই কামতৃষ্ণা দ্বারা চালিত হওয়া, নীত হওয়া,
পরিচালিত হওয়া, বাহিত হওয়া। এ অর্থে সেই কামভোগ প্রার্থনাকারীর।
যা কামসমূহে কামচ্ছন্দ, কামরাগ, কামনন্দী, কামতৃষ্ণা, কামস্নেহ, কামপরিলাহ,
কামবিহ্বলতা, কামাসক্তি, কামোঘো, কামযোগ, কামোপাদান ও কামছন্দ-নীবরণ; সেই কামছন্দ তার
জাত, সঞ্জাত, উৎপত্তি, পুনরুৎপত্তি ও প্রাদুর্ভূত হয়। “মানুষের” বলতে সত্ত্বের, নরের, মানবের, পুরুষের, পুদ্গলের, জীবের, ব্যক্তির,
প্রাণীর, লোকের ও মনুষ্যের। এই অর্থে কামচ্ছন্দজাত ব্যক্তির।
“সেই কামবস্তু
বা বিষয় পরিহীন হয়” সেই কামসমূহ পরিহীন হয় বা কামসমূহ দ্বারা সে পরিক্ষীণ হয়। কিরূপে
সেই কামসমূহ পরিহীন হয়? তার স্থিত ভোগসমূহ রাজাগণ হরণ করেন, চোরগণ হরণ করে, অগ্নিদগ্ধ
হয়, জলে ভেসে যায়, অপ্রিয় পুত্রগণ (দাযাদা) হরণ করে, নিহিত (ভোগ্যবস্তু বা ধন) খুঁজে
পায় না। দুষ্প্রযুক্ত (অসৎ) কর্মে বিনষ্ট হয় অথবা কুলাঙ্গারকুলে চলে যায়; সেই ভোগসমূহ
তার এই আট প্রকার অনিশ্চয়তায় (যত্রতত্র) বিকীর্ণ (বা পরিবেশিত) হয়, নষ্ট হয় ও বিধ্বংস
হয়। এভাবে সেই কামসমূহ ক্ষয় হয়, পরিক্ষয় হয়, ধ্বংস হয়, নষ্ট হয়, অন্তর্ধান হয়, বিলুপ্ত
(বা বিনষ্ট) হয়। কিরূপে কামসমূহ দ্বারা সে পরিক্ষীণ হয়? সে স্থিত ভোগসমূহে চ্যুত হয়,
মৃত্যু হয়, বিধ্বংস হয়। এভাবেই কামসমূহ দ্বারা ক্ষয় হয়, পরিক্ষয় হয়, ধ্বংস হয়, নষ্ট
হয়, অন্তর্ধান হয় এবং বিলুপ্ত হয়।
(ভোগসমূহ) চোর ও রাজাগণ হরণ করেন, অগ্নি দগ্ধ করে, নষ্ট করে। অনন্তর
বিষয়াসক্ত দেহও শেষে (মৃত্যু হলে) তা পরিত্যাগ করে। এসব জ্ঞাত হয়ে পণ্ডিত ব্যক্তি ভোগসমূহ
নিজেও ভোগ করেন এবং দানও করে থাকেন। সামর্থ্য অনুযায়ী দান দিয়ে এবং পরিভোগ করে অনিন্দিত বা দোষমুক্ত স্থান
স্বর্গে গমন করেন। এভাবে সেই কামসমূহ পরিক্ষীণ হয়।
যেমন: লৌহময়, অস্থিময়, দন্তময়, বিষাণময় (শিঙের দ্বারা প্রস্তুত) বা
কাষ্ঠময় শল্য দ্বারা বিদ্ধ হয়ে ব্যথিত হয়, কুপিত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয়, পীড়িত হয়, ব্যাধিগ্রস্ত
হয় ও দুর্মনা হয়; ঠিক এভাবেই বস্তুকামসমূহের জন্য বিপরিণাম, অন্যথাভাব (অস্থিরতা),
শোক, পরিবেদন, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও উপায়াস উৎপন্ন হয়। সেই কামশল্য, শোকশল্য দ্বারা বিদ্ধ
হয়ে ব্যথিত হয়, কুপিত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয়, পীড়িত হয়, ব্যাধিগ্রস্ত হয় এবং দুর্মনা হয়।
এ অর্থে শল্যবিদ্ধ ব্যক্তির ন্যায় ব্যথিত হয়। তাই ভগবান বলেছেন: সেই কামভোগ প্রার্থনাকারীর, কামচ্ছন্দ উৎপন্নকারী ব্যক্তির সেই কামবস্তু
বা বিষয় পরিহীন (ক্ষয়) হলে শল্যবিদ্ধ ব্যক্তির ন্যায় ব্যথিত হয়।
৩. যিনি সর্পশির হতে পা রক্ষার ন্যায় কামভোগ পরিত্যাগ করেন, তিনি এই
তৃষ্ণাবহুল জগতে স্মৃতিমান হয়ে তৃষ্ণা বা আসক্তিকে সমতিক্রম করেন।
“যিনি” বলতে যে, যাদৃশ, যথাযুক্ত, যথাবিহিত, যথা-প্রকার, যে-স্থানপ্রাপ্ত
ও যেই ধর্মসমান্নগত ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, গৃহস্থ, প্রব্রজিত, দেব বা মনুষ্য।
“কাম” (কামা) বলতে প্রধানত (উদ্দানতো) দুই প্রকার কাম; যথা : বস্তুকাম
ও ক্লেশকাম... এগুলোকে বস্তুকাম বলা হয়... এগুলোকে ক্লেশকাম বলা হয়। “কামসমূহ পরিবর্জন করেন” (কামে পরিবজ্জেতি)
অর্থে দুটি ধারায় কামসমূহ পরিত্যাগ করেন বিষ্কম্ভনরূপে (দমনরূপে) বা সমুচ্ছেদরূপে।
কিরূপে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন? “কাম অস্থিকঙ্কাল
সদৃশ স্বাদহীন” দর্শন করে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম বহু সাধারণের (পরিভোগ্য বলে) মাংসপেশীতুল্য” দর্শন করে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম অনুদহনে (বা তেজে দগ্ধ করে বলে) তৃণমশাল সদৃশ” দর্শন করে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম মহাপরিদাহের (বা মহাতাপ প্রদান হেতুতে) অঙ্গারগর্ত সদৃশ” দর্শন করে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নতুল্য” দর্শন করে
বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম তাবৎকালিক
বা যখন-তখন সেবন করতে হয় বলে যাচক সদৃশ” দর্শন করে
বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
দুর্বল করে বলে বৃক্ষফল তুল্য” দর্শন করে
বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম কুটনার্থে
বধ্যভূমির কাষ্ঠখণ্ড সদৃশ” দর্শন করে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম বিদ্ধকরণের শক্তিশেল সদৃশ” দর্শন করে
বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম বিপজ্জনক
সর্পশির সদৃশ” দর্শন করে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম নরকোত্তাপ (অত্যন্ত উত্তপ্ত) অগ্নিস্কন্ধ সদৃশ” দর্শন করে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন।
বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনাকালে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিত্যাগ করেন, ধর্মানুস্মৃতি
ভাবনাকালে... সংঘানুস্মৃতি ভাবনাকালে... শীলানুস্মৃতি ভাবনাকালে... ত্যাগানুস্মৃতি
ভাবনাকালে... দেবতানুস্মৃতি ভাবনাকালে... আনাপানস্মৃতি ভাবনাকালে... মরণানুস্মৃতি ভাবনাকালে...
কায়গতানুস্মৃতি ভাবনাকালে... এবং উপশমানুস্মৃতি ভাবনাকালে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিত্যাগ
করেন।
প্রথম ধ্যান ভাবনাকালে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিত্যাগ করেন, দ্বিতীয়
ধ্যান ভাবনাকালে... তৃতীয় ধ্যান ভাবনাকালে... চতুর্থ ধ্যান ভাবনাকালে... আকাশায়তন-সমাপত্তি
ভাবনাকালে... বিজ্ঞানায়তন-সমাপত্তি ভাবনাকালে... অকিঞ্চনায়তন-সমাপত্তি ভাবনাকালে...
এবং নৈবসংজ্ঞা-নাসংজ্ঞায়তন-সমাপত্তি ভাবনাকালে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিত্যাগ করেন।
এভাবেই বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন।
কিরূপে সমুচ্ছেদরূপে কামসমূহ পরিত্যাগ করেন? স্রোতাপত্তিমার্গ ভাবনাকালে
অপায়গমনীয় (বা অপায়ে নীতকারী) কামসমূহ সমুচ্ছেদরূপে পরিত্যাগ করেন, সকৃদাগামীমার্গ
ভাবনাকালে স্থুল কামসমূহ সমুচ্ছেদরূপে পরিত্যাগ করেন, অনাগামীমার্গ ভাবনাকালে অনুসহগত
কামসমূহ সমুচ্ছেদরূপে পরিত্যাগ করেন, অর্হত্ত্বমার্গ ভাবনাকালে পরিপূর্ণভাবে, সম্পূর্ণরূপে,
অশেষরূপে এবং নিঃশেষরূপে কামসমূহ সমুচ্ছেদরূপে পরিত্যাগ করেন। এভাবেই সমুচ্ছেরূপে কামসমূহ
পরিবর্জন করেন। এ অর্থে বলা হয়েছে, যিনি কামসমূহ পরিত্যাগ করেন।
সর্প বলতে সাপকে বুঝায়। কোন অর্থে সর্প? বুকে হেঁটে গমন করে বলে সর্প;
আঁকাবাঁকা করে গমন করে বলে ভুজঙ্গ; উর দিয়ে চলে বলে উরগ; শির অবনমিত করে চলে বলে পন্নগ;
শির দ্বারা নিদ্রা যায় বলে সরীসৃপ; বিল বা গর্তে শয়ন করে বলে বিলাশ্রয়ী; গুহায় শয়ন
করে বলে গুহাশ্রয়ী; দাঁতগুলো তার অস্ত্রশস্ত্র বলে দন্তাস্ত্রধারী (দাঠাৰুধো); তার
বিষ বিষম বলে ঘোরবিষ; জিহ্বা দ্বিধাবিভক্ত (দুটি) বলে দ্বিজিহ্ব এবং দুই জিহ্বা দিয়ে
রসের (খাদ্যের) স্বাদ বা গন্ধ নেয় বলে রসজ্ঞ। যেমন : প্রাণাকাঙ্ক্ষী, অমরণাকাঙ্ক্ষী,
সুখকামী ও দুঃখবিরোধী পুরুষ স্বীয় পাদ সর্পশির হতে দূরে রাখে, বিরত রাখে এবং পরিত্যাগ
করে (বা এড়িয়ে চলে); ঠিক এভাবেই সুখকামী, দুঃখবিরোধী (ব্যক্তি) কামসমূহ বর্জন করেন,
বিবর্জন করেন, পরিত্যাগ করেন। এই অর্থে সর্পশির হতে পা রক্ষার ন্যায়।
“তিনি” বলতে যিনি কামসমূহ পরিবর্জন করেন। ‘আসক্তি’ তৃষ্ণাকে বুঝায়। যা রাগ, সরাগ, অনুনয়, অনুরোধ, নন্দী, নন্দিরাগ; চিত্তের
সরাগ, ইচ্ছা, মূর্ছা, আসক্তি, অনুরাগ, লোভ (পলিগেধো), বিষয়ানুরাগ (সঙ্গো), মালিন্য
(পঙ্কো); তীব্র আকাঙ্ক্ষা (এজা), মায়া, জননী, সঞ্জননী, লিপ্সা (সিব্বিনী), বাসনা, তৃষ্ণা
(সরিতা), স্পৃহা; যোগ, যোগসূত্র, প্রবৃত্তি (আযূহিনী), সহচর (দুতিযা), প্রণিধি, ভবনেত্রী
(পুনর্জন্ম প্রদানকারী নেতা); ইচ্ছা, বলবতী ইচ্ছা, সম্বন্ধ (সন্ধৰো), স্নেহ, অভিলাষ
(অপক্খো), প্রতিবন্ধু; আশা, প্রত্যাশা, প্রবলতৃষ্ণা; রূপ-আশা, শব্দ-আশা, গন্ধ-আশা,
রস-আশা, স্পর্শ-আশা; লাভ-বাসনা, ধন-বাসনা, পুত্র-বাসনা, জীবন-বাসনা; কামনা, বলবতী স্পৃহা,
অভিপ্রায়, অভিলাষ, আকাঙ্ক্ষা, লোলুপ, লোলুপতা, প্রলুব্ধতা, প্রলোভনতা, আকুলতা; পাপধর্মরাগ,
বিষমলোভ, তীব্র আসক্তি, প্রবলেচ্ছা, প্রার্থনা, অনুনয়, সানুনয়; কামতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা,
বিভবতৃষ্ণা; রূপতৃষ্ণা (রূপব্রহ্মলোকের প্রতি আসক্তি), অরূপতৃষ্ণা, নিরোধতৃষ্ণা; রূপতৃষ্ণা,
শব্দতৃষ্ণা, গন্ধতৃষ্ণা, রসতৃষ্ণা, স্পর্শতৃষ্ণা, ধর্মতৃষ্ণা; ওঘ, যোগ, গ্রন্থি, উপাদান,
আবরণ, নীবরণ, আচ্ছাদন, বন্ধন, উপক্লেশ, অনুশয়, পর্যুত্থান (বা প্রবণতা), লতা, প্রবল
বাসনা; দুঃখমূল, দুঃখনিদান, দুঃখপ্রভব (দুঃখোৎপত্তি); মার-ফাঁদ, মার-বড়শি, মার-জগৎ;
এবং তৃষ্ণা-নদী, তৃষ্ণা-জাল, তৃষ্ণা-রজ্জু, তৃষ্ণা-সমুদ্র, অভিধ্যা, লোভ ও অকুশলমূল।
কোন অর্থে তৃষ্ণা? (অতৃপ্ত) বাসনা বলে তৃষ্ণা, বিশাল বা বহুল বলে তৃষ্ণা,
আসক্তি বলে তৃষ্ণা, বিষম বলে তৃষ্ণা, বিশেষভাবে সংগৃহীত হয় বলে তৃষ্ণা,
প্রতারণা করে বলে তৃষ্ণা, বিষমূল বলে তৃষ্ণা, বিষফল বলে তৃষ্ণা, বিষ-পরিভোগ
বলে তৃষ্ণা। অথবা সেই বহুল তৃষ্ণা রূপে, শব্দে, গন্ধে, রসে, স্পর্শে; কুলে, গণে, আবাসে,
লাভে, যশে; প্রশংসায়, সুখে, চীবরে, পিণ্ডপাতে, শয্যাসনে, ওষুধ-প্রত্যয়-ভৈষজ্য-পরিষ্কারে;
কামধাতুতে, রূপধাতুতে, অরূপধাতুতে; কামভবে, রূপভবে, অরূপভবে; সংজ্ঞাভবে, অসংজ্ঞাভবে,
নৈবসংজ্ঞা-নাসংজ্ঞাভবে, একবোকারভবে, চারিবোকারভবে, পঞ্চবোকারভবে; অতীতে, অনাগতে, বর্তমানে
এবং দৃষ্ট-শ্রুত-অনুমিত-বিজ্ঞাতব্য ধর্মসমূহে তৃষ্ণা বিস্তৃত বলেই তৃষ্ণা।
“লোকে” (লোকে) বলতে অপায়লোকে, মনুষ্যলোকে, দেবলোকে, স্কন্ধলোকে, ধাতুলোকে,
আয়তনলোকে। “স্মৃতিমান” (সতো) বলতে
চারটি কারণে (বা বিষয়ে) স্মৃতিমান-কায়ে কায়ানুদর্শী স্মৃতিপ্রস্থান ভাবনাকালে স্মৃতিমান,
বেদনায়... চিত্তে... এবং ধর্মে ধর্মানুদর্শী স্মৃতিপ্রস্থান ভাবনাকালে স্মৃতিমান।
অপর চারটি কারণে স্মৃতিমান; যথা : ১) অস্মৃতি পরিবর্জিত হওয়ায় স্মৃতিমান,
২) স্মৃতিকরণীয় ধর্মসমূহ কৃত হওয়ায় স্মৃতিমান, ৩) স্মৃতিপ্রতিপক্ষ ধর্মসমূহ বশীভূত
বা হত হওয়ায় স্মৃতিমান, এবং ৪) স্মৃতিনিমিত্ত ধর্মসমূহের ভুল না হওয়ায় স্মৃতিমান। অন্য চারটি কারণে স্মৃতিমান; যথা : ১) স্মৃতিতে সমন্বিত হওয়ায়
স্মৃতিমান, ২) স্মৃতিতে বশীভূত হওয়ায় স্মৃতিমান, ৩) স্মৃতিতে প্রাগুণ্য বা নিপুণ হওয়ায়
স্মৃতিমান, এবং ৪) স্মৃতিতে অপ্রত্যারোহণ হওয়ায় স্মৃতিমান। অপর চারটি কারণে স্মৃতিমান; যথা : ১) সত্ত্বত্ব (অস্তিত্বপ্রাপ্ত)
বলে স্মৃতিমান, ২) শান্ততাপ্রাপ্ত বলে স্মৃতিমান, ৩) স্থিরতাপ্রাপ্ত বলে স্মৃতিমান
এবং ৪) শান্তধর্মে সমন্বিত বলে স্মৃতিমান। বুদ্ধানুস্মৃতির দ্বারা স্মৃতিমান, ধর্মানুস্মৃতির
দ্বারা স্মৃতিমান, সংঘানুস্মৃতির দ্বারা স্মৃতিমান, শীলানুস্মৃতির দ্বারা স্মৃতিমান,
ত্যাগানুস্মৃতির দ্বারা স্মৃতিমান, দেবতানুস্মৃতির দ্বারা স্মৃতিমান, আনাপানস্মৃতির
দ্বারা স্মৃতিমান, মরণানুস্মৃতির দ্বারা স্মৃতিমান, কায়গতস্মৃতির দ্বারা উপশমানুস্মৃতির
দ্বারা স্মৃতিমান। যা স্মৃতি, অনুস্মৃতি, স্মরণ (মনযোগিতা), স্মৃতি স্মরণতা, ধারণতা,
নির্ণয়করণতা (অপিলাপনতা), স্মৃতিশীলতা, স্মৃতি, স্মৃতীন্দ্রিয়, স্মৃতিবল, সম্যক স্মৃতি,
স্মৃতি-সম্বোধ্যঙ্গ, একায়ন মার্গ, ইহাকে স্মৃতি বলা হয়। এই স্মৃতিতে উপনীত, সমুপনীত,
উপগত, সমুপগত, উপপন্ন (প্রতিপন্ন), সমুপপন্ন ও সমান্নগত হন; তাই স্মৃতিমান বলা হয়।
জগতে স্মৃতিমান হয়ে যিনি সেই তৃষ্ণা বা আসক্তিকে অতিক্রম করেন, জয় করেন,
দমন করেন, সমতিক্রম করেন, পরাজিত করেন, তিনি এই তৃষ্ণাবহুল জগতে স্মৃতিমান হয়ে তৃষ্ণা
বা আসক্তিকে সমতিক্রম করেন। তাই ভগবান বলেছেন: যিনি সর্পশির হতে পা রক্ষার ন্যায় কামভোগ পরিত্যাগ
করেন, তিনি এই তৃষ্ণাবহুল জগতে স্মৃতিমান হয়ে তৃষ্ণা বা আসক্তিকে সমতিক্রম করেন।
৪. যে ব্যক্তি ক্ষেত্র, বস্তু, হিরণ্য, গরু, অশ্ব, দাস, পুরুষ, বন্ধু
ইত্যাদি বহুবিধ কামবস্তু বা বিষয় (কামনা করে) অত্যন্ত লোভ করে।
“ক্ষেত্র” (খেত্তং) বলতে শালিক্ষেত্র, শস্যক্ষেত্র, মুগ (ডাল) ক্ষেত্র, মাষ
(এক প্রকার শিমজাতীয় ফসল) ক্ষেত্র, যবক্ষেত্র, গোধূম (গম) ক্ষেত্র, তিলক্ষেত্র। “বস্তু” (ৰত্থুং) অর্থে ঘর-বস্তু (বাস্তুভিটা), প্রকোষ্ঠ-বস্তু, পূর্বদিকস্থ-বস্তু,
পশ্চাদ্দিক-বস্তু, আরাম বা বাগান-বস্তু, বিহার-বস্তু। “হিরণ্য” বলতে কার্ষাপণ বা মুদ্রাকে হিরণ্য বুঝানো হয়। এ অর্থে ক্ষেত্র,
বস্তু, হিরণ্য। “গো” (গৰং) বলতে গরু; “অশ্ব” (অস্সা) বলতে দুটি পশুকে বোঝায়। “দাস” (দাসা) বলতে চার প্রকার দাস; যথা : ১) আজন্ম বা জন্মহেতু দাস, ২) ধনক্রীত
দাস, ৩) দাস্যবৃত্তিতে বা স্বীয় ইচ্ছায় দাস, ৪) ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা হতভাগ্যে দাস। ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাস, ধনক্রীত দাস, দাস্যবৃত্তিতে দাস, জন্ম হতে
নিঃস্ব বা অভাব-হেতুতে দাস, এভাবে দাস হয়ে থাকে। “পুরুষ” বলতে তিন প্রকার পুরুষ; যথা : ১) ভৃত্য, ২) কর্মচারী বা কর্মী,
৩) উপজীবী বা কারোর উপর জীবিকা নির্বাহকারী। উপরোক্ত অর্থে গরু, অশ্ব, দাস, পুরুষ।
“স্ত্রীলোক” (থিযো) বলতে দারপরিগ্রহ বুঝায়। “বন্ধু” (বন্ধূ) বলতে চার প্রকার বন্ধু; যথা: ১) জ্ঞাতি বন্ধু, ২) গোত্র বন্ধু,
৩) পরামর্শদাতা বন্ধু, ৪) সহকর্মী বন্ধু। “বহুবিধ কামনায়” (পুথু কামে) বলতে নানা কাম্যবিষয়ে। এসব স্থুলকামসমূহ মনোজ্ঞ রূপ...
মনোজ্ঞ স্পৃষ্টব্য বিষয়। এসব অর্থে স্ত্রীলোক, বন্ধু, বহুবিধ কামনায় বলা হয়েছে।
“যেই” (যো) বলতে যে, যেরূপ, যথোপযুক্ত, যথাবিহিত, যথাপ্রকার, যেই স্থানপ্রাপ্ত
এবং যে ধর্মসমন্বিত ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, গৃহস্থ, প্রব্রজিত, দেবতা ও
মানুষ। “মানুষ” (নরো) বলতে সত্ত্ব, নর, মানব, পুরুষ, পুদ্গল, জীব, ব্যক্তি,
প্রাণী, লোক, মনুষ্য। “লোভ করা” (অনুগিজ্ঝতি)
বলতে ক্লেশকাম দ্বারা বস্তুকামসমূহে লোভাতুর হওয়া, লোভ করা, আকাঙ্ক্ষা করা ও দৃঢ়াবদ্ধ
হওয়া। এ অর্থে বলা হয়েছে, যে নর লোভ করে। তাই ভগবান বলেছেন: যে ব্যক্তি ক্ষেত্র, বস্তু, হিরণ্য, গরু, অশ্ব, দাস, পুরুষ, বন্ধু ইত্যাদি
বহুবিধ কামবস্তু বা বিষয় (কামনা করে) অত্যন্ত লোভ করে।
৫. দুর্বল ব্যক্তি যেভাবে বলবানের দ্বারা মর্দিত, নিপীড়িত হয়, সেভাবে
ভাঙা নৌকার মধ্যে জল প্রবেশের ন্যায় দুঃখ তার অনুসরণ করে। “দুর্বল” দুর্বল, শারীরিক ক্লেশতা, দুর্বলতা, অল্পবলতা, অপ্রবলতা, নির্বলতা,
ভগ্নোদ্যমতা, অতি দুর্বলতা, বলহীনতা ও অপ্রসন্নতা বুঝানো হয়েছে। সেসব ক্লেশ সেই পুরুষকে
পরাভূত করে, বশীভূত করে, পরাজিত করে, আবৃত করে, অভিভূত করে, মর্দন করে। এরূপেই বলহীনতারূপ
ক্লেশসমূহ তাকে পরাভূত করে। অপিচ, বলহীন, দুর্বল, হীনবল, অল্পশক্তিবান, নির্বল, অপ্রবল,
সামান্য শক্তিসম্পন্ন, ভগ্নোদ্যম, অতি দুর্বল, বলহীন পুরুষকে-যার শ্রদ্ধাবল, বীর্যবল,
স্মৃতিবল, সমাধিবল, প্রজ্ঞাবল, লজ্জাবল, ভয়বল নেই; এই ক্লেশসমূহ সেই পুদ্গলকে পরাভূত
করে, বশীভূত করে, পরাজিত করে, আবৃত করে, অভিভূত করে, মর্দন করে; এরূপেই বলহীনতারূপ
দুর্বল বলবানের দ্বারা মর্দিত হয়। দুঃখ কিরূপ? সিংহ, ব্যঘ্র, সীতাবাঘ, ভালুক, হায়েনা, নেক্রেবাঘ, মহিষ,
হস্তি, সর্প, বৃশ্চিক, শতপদী, চোর, ক্রন্দনরত মানুষ, কৃতকর্মা, অকৃতকর্মা এবং চক্ষুরোগ,
শ্রোত্ররোগ, ঘ্রাণরোগ, জিহ্বারোগ, কায়রোগ, শিররোগ, কর্ণরোগ, মুখরোগ, দন্তরোগ, কাশিরোগ,
শ্বাসরোগ, দাহরোগ, জ্বর, কুক্ষিরোগ, মূর্ছা, রক্তামাশয়, শূলরোগ, কলেরা, কুষ্ঠরোগ, গণ্ড
(ফোড়া), খোঁচপাচড়া, ক্ষয়রোগ, মৃগীরোগ (অপমারো), দাউদ, চুলকানি, চর্মরোগ, রখস (নখের
একপ্রকার রোগ), সুড়সুড়ানি, লোহিতপিত্ত, মধুমেহ (শর্করাযুক্ত বহুমূত্র রোগ), অর্শ্বরোগ,
গুটিবসন্ত, ভগন্দর (গুহ্যদ্বারে ব্রণজাতীয় রোগ), পিত্তসমুত্থানজনিতরোগ, শ্লেষ্মা-সমুত্থানজনিত
রোগ, বায়ুসমুত্থানজনিত রোগ, সান্নিপাতিক রোগ, ঋতুপরিবর্তনজনিত রোগ, বিষম পরিহারজ (বিপরীত
ব্যবহারজনিত) রোগ, খিঁচুনিরোগ (ওপক্কমিকেন), কর্মবিপাকজনিত রোগ এবং শীত, উষ্ণ, ক্ষুধা,
পিপাসা, মল, মুত্র, ডাঁশ-মশা-মাছি-সরিসৃপাদির সংস্পর্শ, এগুলোকে বলা হয় প্রকাশিত দুঃখ।
প্রতিচ্ছন্ন বা গুপ্ত দুঃখ কিরূপ? কায়দুশ্চরিত, বাক্দুশ্চরিত, মনোদুশ্চরিত,
কামচ্ছন্দ নীবরণ, ব্যাপাদ নীবরণ, তদ্রালস্য নীবরণ, চঞ্চলতা-অনুশোচনা নীবরণ, বিচিকিৎসা
নীবরণ, রাগ, দ্বেষ, মোহ, ক্রোধ, বিদ্বেষ, ভণ্ডামি, আক্রোশ, ঈর্ষা, মাৎসর্য, প্রবঞ্চনা,
একগুঁয়েমি, কলহ, মান, অতিমান, গর্ব, প্রমাদ এবং সকল ক্লেশ, সকল দুশ্চরিত, সকল দুশ্চিন্তা,
সকল উত্তেজনা, সকল অন্তর্দাহ ও সকল অকুশল অভিসংস্কার; এগুলোকে বলা হয় অপ্রকাশিত বা
গুপ্ত দুঃখ।
দুঃখ বলা হয়, কোন অর্থে দুঃখ? বশীভূত করে বলে দুঃখ, পরিহানীতে চালিত
করে বলে দুঃখ, সেই শরীরে আশ্রয় করে বলে দুঃখ। কিরূপে বশীভূত করে দুঃখ দেয়? সেই পুরুষকে
সেই দুঃখসমূহে পরাভূত করে, বশীভূত করে, পরাজিত করে, আবৃত করে, অভিভূত করে, মর্দন করে,
এরূপে বশীভূত করে দুঃখ দেয়। কিরূপে পরিহানীতে চালিত করে দুঃখ দেয়? কুশলধর্মসমূহে অন্তরায়
করে পরিহানীতে চালিত করে দুঃখ দেয়। কুশলধর্মসমূহ কিরূপ? সম্যক প্রতিপদা, অনুলোম প্রতিপদা,
অবিরুদ্ধ প্রতিপদা, ধারণ অনুরূপ প্রতিপদা, ধর্মানুধর্ম প্রতিপদা এবং শীলসমূহে পরিপূর্ণতায়,
ইন্দ্রিয়সমূহ সংযমতায়, ভোজনে মাত্রাজ্ঞতায় ও জাগ্রত অবস্থায়, স্মৃতি সম্প্রজ্ঞান অবস্থায়,
চারি স্মৃতি প্রস্থানে জাগ্রত অবস্থায়, চারি সম্যক প্রধানে জাগ্রত অবস্থায়, সপ্ত বোধ্যাঙ্গে
জাগ্রত অবস্থায়, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে জাগ্রত অবস্থায়, এই কুশলধর্মসমূহে অন্তরায়
করে পরিহানীতে চালিত হয়। এভাবে পরিহানিতে চালিত করে। এ অর্থে দুঃখ।
আশ্রয় করা দুঃখসমূহ কিরূপ? তথায় যে অকুশল-পাপধর্মসমূহ নিজে সন্নিশ্রিত
হয়ে উৎপন্ন হয়। যেমন: বিলে আশ্রয় অবস্থানকারী প্রাণীসমূহ বিলে বাস করে, জলজ প্রাণীসমূহ
জলে বাস করে, বন্যপ্রাণীসমূহ বনে বাস করে, গাছে অবস্থানকারী প্রাণীসমূহ গাছে অবস্থান
করে। ঠিক এরূপেই তথায় এই অকুশল ধর্ম সমূহ নিজের সন্নিশ্রিত হয়েই উৎপন্ন হয়। তথায় এরূপে
আশ্রয় করে। এ অর্থে দুঃখ। তাই ভগবান বলেছেন: “হে ভিক্ষুগণ,
অন্তেবাসী ও আচার্যসহ (সাচরিযকো) অবস্থানকারী ভিক্ষু দুঃখে অবস্থান করে স্বচ্ছন্দে
নয়। ভিক্ষুগণ, অন্তেবাসী ও আচার্যসহ অবস্থানকারী ভিক্ষু কীভাবে দুঃখে অবস্থান করে স্বচ্ছন্দে
নয়? এখানে চক্ষু দ্বারা রূপ দেখে ভিক্ষুর যেই পাপজনক অকুশলধর্ম ও সংযোজনমূলক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
উৎপন্ন হয়, সেই পাপজনক অকুশলধর্মসমূহ তার অন্তরে অবস্থান করে ও স্রাবিত হয়, তদ্ধেতু
অন্তেবাসীসহ বলা হয়। সেগুলো তাকে বেষ্টন করে। পাপজনক অকুশলধর্মসমূহ তাকে বেষ্টন করে,
সেহেতু আচার্যসহ (সাচরিযকো) বলা হয়।”
“পুনঃ, ভিক্ষুগণ,
শ্রোত্র দ্বারা শব্দ শুনে, ঘ্রাণ দ্বারা গন্ধ গ্রহণ করে, জিহ্বা দ্বারা রসাস্বাদন করে,
কায় দ্বারা স্পর্শ করে এবং মন দ্বারা ধর্মানুভব করে ভিক্ষুর যেই পাপজনক অকুশলধর্ম ও
সংযোজনমূলক উচ্চাকাঙ্ক্ষা উৎপন্ন হয়, সেই পাপজনক অকুশলধর্মসমূহ তার অন্তরে অবস্থান
করে ও স্রাবিত হয়-তদ্ধেতু অন্তেবাসীসহ বলা হয়। সেগুলো তাকে বেষ্টন করে। পাপজনক অকুশলধর্মসমূহ
তাকে বেষ্টন করে, সেহেতু আচার্যসহ বলা হয়। ভিক্ষুগণ, এভাবেই অন্তেবাসী ও আচার্যসহ অবস্থানকারী
ভিক্ষু দুঃখে অবস্থান করে স্বচ্ছন্দে নয়।” তথায় এরূপে
আশ্রয় করে—‘পরস্সিযা’।
ভগবান বলেছেন: “ভিক্ষুগণ,
অন্তর (মন)-অমিত্র, অন্তর-শত্রু, অন্তর-ঘাতক ও অন্তর-বিরোধী তিন প্রকার অন্তর্মল আছে।
তিন প্রকার কী কী? অন্তর-অমিত্র, অন্তর-শত্রু , অন্তর-ঘাতক ও অন্তর-বিরোধী লোভ অন্তর্মল।
দ্বেষ অন্তর্মল.... এবং অন্তর-অমিত্র, অন্তর-শত্রু , অন্তর-ঘাতক ও অন্তর-বিরোধী মোহ
অন্তর্মল। ভিক্ষুগণ, এগুলোই অন্তর-অমিত্র, অন্তর-শত্রু , অন্তর-ঘাতক ও অন্তর-বিরোধী
তিন প্রকার অন্তর্মল।” “লোভে যে অনর্থ জন্মে, চিত্ত কম্পিত হয়, অন্তরে ভয় জন্মায় তা মানুষেরা
জানে না। লোভী ব্যক্তি অর্থ জ্ঞাত হয় না, ধর্ম দেখতে পায় না। ঘনান্ধকার ঘনিয়ে আসলে
লোভ মানুষকে পরাজিত করে। দ্বেষে যে অনর্থ জন্মে, চিত্ত কম্পিত হয়, অন্তরে ভয় জন্মায়
তা মানুষেরা জানে না। ক্রুদ্ধ ব্যক্তি অর্থ জ্ঞাত হয় না, ধর্ম দেখতে পায় না। ঘনান্ধকার
ঘনিয়ে আসলে দ্বেষ মানুষকে পরাজিত করে। মোহে যে অনর্থ জন্মে, চিত্ত কম্পিত হয়, অন্তরে
ভয় জন্মায় তা মানুষেরা জানে না। মূর্খ ব্যক্তি অর্থ জ্ঞাত হয় না, ধর্ম দেখতে পায় না।
ঘনান্ধকার ঘনিয়ে আসলে মোহ মানুষকে পরাজিত করে।”
এরূপে
আশ্রয় করে—‘পরস্সিযা’।
ভগবান বলেছেন, “মহারাজ, ত্রিবিধ
ধর্ম আধ্যাত্মিকভাবে উৎপন্ন হবার কারণ থাকলে তা পুরুষের অহিত, দুঃখ ও নিরানন্দের জন্যই
উৎপন্ন হয়। ত্রিবিধ কী কী? মহারাজ, লোভধর্ম আধ্যাত্মিকভাবে উৎপন্ন হবার কারণ থাকলে
তা পুরুষের অহিত, দুঃখ ও নিরানন্দের জন্যই উৎপন্ন হয়। দ্বেষধর্ম... এবং মোহধর্ম আধ্যাত্মিকভাবে
উৎপন্ন হবার কারণ থাকলে তা পুরুষের অহিত, দুঃখ ও নিরানন্দের জন্যই উৎপন্ন হয়। মহারাজ,
এই ত্রিবিধ ধর্মই আধ্যাত্মিকভাবে উৎপন্ন হবার কারণ থাকলে তা পুরুষের অহিত, দুঃখ এবং
নিরানন্দের জন্য উৎপন্ন হয়। “সারবান, ফলবান
বৃক্ষসদৃশ লোভ, দ্বেষ, মোহ এবং আত্মসম্ভূত বিষয়সমূহ পুরুষকে পীড়া দিয়ে থাকে।” এরূপে আশ্রয় করে—‘পরস্সিযা’।
ভগবান বলেছেন: “এই (মন) হতেই
রাগ-দ্বেষের উৎপত্তি হয়, অরতি-রতি, রোমাঞ্চকরও এই (মন) হতে উৎপন্ন হয়; এই (মন) হতেই
মনোবিতর্ক উৎপন্ন হয়, বালকের দ্বারা যেমন কাক উত্তেজিত হয়।” এরূপে আশ্রয় করে—‘পরস্সিযা’। সেই অনিষ্টকর
বিষয়সমূহ পুদ্গলকে পরাজিত করে, জয় করে, পরাস্ত করে, পরাভূত করে, বশীভূত করে, মর্দিত
করে—এ অর্থে অনিষ্টকর বিষয়সমূহ তাকে মর্দন করে বলা হয়।
“তখন হতে” বলতে সেই সেই হতে বিপদরূপে সেই পুদ্গলকে দুঃখ অনুসরণ করে, অনুগমন করে,
সহযাত্রী হয়; জন্মদুঃখ অনুসরণ করে, অনুগমন করে, সহযাত্রী হয়; জরাদুঃখ অনুসরণ করে, অনুগমন
করে, সহযাত্রী হয়; ব্যাধিদুঃখ অনুসরণ করে, অনুগমন করে, সহযাত্রী হয়; শোক-পরিদেবন-দুঃখ-দৌমনস্য-উপায়াস
দুঃখ অনুসরণ করে, অনুগমন করে, সহযাত্রী হয়; নৈরয়িক দুঃখ, তির্যগ্কুল দুঃখ, প্রেতকুল
দুঃখ অনুসরণ করে, অনুগমন করে, সহযাত্রী হয়; মানসিক দুঃখ... গর্ভে প্রবেশমূলক দুঃখ...
গর্ভে স্থিতি বা অবস্থানমূলক দুঃখ... গর্ভ হতে নির্গমনমূলক দুঃখ... জন্মের সম্বন্ধমূলক
দুঃখ... জন্মের পরাধীনতামূলক দুঃখ... আত্মপীড়নমূলক দুঃখ... পরপীড়নমূলক দুঃখ অনুসরণ
করে, অনুগমন করে, সহযাত্রী হয়; দুঃখ দুঃখ অনুসরণ করে, অনুগমন করে, সহযাত্রী হয়; সংস্কারদুঃখ...
বিপরিণাম দুঃখ...। চক্ষুরোগ, শ্রোত্ররোগ, ঘ্রাণরোগ, জিহ্বারোগ, কায়রোগ, শিররোগ, কর্ণরোগ,
মুখরোগ, দন্তরোগ, কাশিরোগ, শ্বাসরোগ, দাহরোগ, জ্বর, কুক্ষিরোগ, মূর্ছা, রক্তামাশয়,
শূলরোগ, কলেরা, কুষ্ঠরোগ, গণ্ড (ফোড়া), খোঁচপাচড়া, ক্ষয়রোগ, মৃগীরোগ (অপমারো), দাউদ,
চুলকানি, চর্মরোগ, রখস (নখের একপ্রকার রোগ), সুড়সুড়ানি, লোহিতপিত্ত, মধুমেহ (শর্করাযুক্ত
বহুমূত্র রোগ), অর্শ্বরোগ, গুটিবসন্ত, ভগন্দর (গুহ্যদ্বারে ব্রণজাতীয় রোগ), পিত্ত-সমুত্থানজনিতরোগ,
শ্লেষ্মা-সমুত্থানজনিত রোগ, বায়ুসমুত্থানজনিত রোগ, সন্নিপাতিকরোগ, ঋতুপরিবর্তনজনিত
রোগ, বিষম পরিহারজ (বা বিপরীত ব্যবহারজনিত) রোগ, খিঁচুনিরোগ (ওপক্কমিকা), কর্মবিপাকজনিত
রোগ এবং শীত, উষ্ণ, ক্ষুধা, পিপাসা, মল, মুত্র, ডাঁশ-মশা-মাছি-সরিসৃপাদির সংস্পর্শ
দুঃখ... মাতামৃত্যু দুঃখ... পিতামৃত্যু দুঃখ... ভ্রাতামৃত্যু দুঃখ... ভগ্নিমৃত্যু দুঃখ...
পুত্রমৃত্যু দুঃখ... কন্যামৃত্যু দুঃখ... জ্ঞাতিমৃত্যু দুঃখ... ভোগ্যবস্তু ক্ষয়জনিত
দুঃখ... রোগব্যসন দুঃখ... শীল লঙ্ঘনজনিত দুঃখ... এবং দৃষ্টিব্যসন দুঃখ (ভ্রান্তধারণাজনিত
দুঃখ) অনুসরণ করে, অনুগমন করে ও সহযাত্রী হয় বা তখন হতে তাকে দুঃখ অনুসরণ করে।
যেমন : ভগ্ন নৌকায় জল প্রবেশ করে সেই হতে জল অনুসরণ করে, অনুগমন করে,
অনুগামী হয়; অগ্রে অগ্রে জল অনুসরণ করে, অনুগমন করে, অনুগামী হয়; পশ্চাৎ পশ্চাৎ...
নিচে নিচে... এবং পার্শ্বে পার্শ্বে জল অনুসরণ করে, অনুগমন করে, অনুগামী হয়; ঠিক সেভাবেই
সেই সেই হতে বিপদরূপে সেই পুদ্গলকে দুঃখ অনুসরণ করে, অনুগমন করে এবং অনুগামী হয়; জন্মদুঃখ
অনুসরণ করে, অনুগমন করে, সহযাত্রী হয়... এবং দৃষ্টিব্যসন দুঃখ (ভ্রান্ত ধারণাজনিত দুঃখ)
অনুসরণ করে, অনুগমন করে ও সহযাত্রী হয়-ভগ্ন নৌকায় জল প্রবেশের ন্যায়। তদ্ধেতু ভগবান
বলেছেন :
দুর্বল ব্যক্তি যেভাবে বলবানের দ্বারা
মর্দিত, নিপীড়িত হয়, সেভাবে ভাঙা নৌকার মধ্যে জল প্রবেশের ন্যায় দুঃখ তার অনুসরণ করে।
৬. তদ্ধেতু মানুষ সদা স্মৃতিমান হয়ে কামসমূহ পরিবর্জন করেন। (ভারী)
নৌকা জল ছাড়িয়ে গমন করার ন্যায় পরপারে গমনেচ্ছু ব্যক্তি (পারগূ) সেই সব (বস্তুকাম,
ক্লেশকাম, পঞ্চনীবরণ) পরিত্যাগ করে স্রোত উত্তীর্ণ হন।
“তদ্ধেতু” বলতে সেজন্য, সেই কারণ, সেই হেতু, সেই প্রত্যয়, সেই নিদান এবং কর্মসমূহে
এই আদীনব দর্শন করতে—তদ্ধেতু। “জন্তু বা মানুষ” বলতে সত্ত্ব, নর, মানব, পুরুষ, পুদ্গল, জীব, প্রাণী, ব্যক্তি, মানুষ,
মনুষ্য। “সর্বদা” অর্থে সদা, সর্বদা, সর্বকাল, অবিরত, ধ্রুবকাল, সতত, অনুক্ষণ,
নিরবিচ্ছিন্নভাবে, অনুক্রমে, জল তরঙ্গের সদৃশ, নিরন্তর, স্থিতিকাল, ঘটিত, বায়ুতে স্পর্শিত,
সকাল, বিকাল, প্রথম যাম, মধ্যম যাম, অন্তিম যাম, কৃষ্ণপক্ষ, শুক্লপক্ষ, বর্ষা, হেমন্ত,
প্রথম বয়ঃস্কন্ধ, মধ্যম বয়ঃস্কন্ধ, অন্তিম বয়ঃস্কন্ধ। “স্মৃতিমান” (সতো) বলতে চারটি কারণে (বা বিষয়ে) স্মৃতিমান-কায়ে কায়ানুদর্শী
স্মৃতিপ্রস্থান ভাবনাকালে স্মৃতিমান, বেদনায়... চিত্তে... এবং ধর্মে ধর্মানুদর্শী স্মৃতিপ্রস্থান
ভাবনাকালে স্মৃতিমান। তাই স্মৃতিমান বলা হয়। এ অর্থে স্মৃতিমান।
অপর চারটি কারণে স্মৃতিমান... তাই স্মৃতিমান বলা হয়; তদ্ধেতু মানব সদা
স্মৃতিমান। “কাম” বলতে বিভাগ অনুযায়ী কাম দুই প্রকার—বস্তুকাম ও ক্লেশকাম... এগুলোকে বস্তুকাম বলা হয়;... এগুলোকে ক্লেশকাম
বলা হয়। “কামসমূহ পরিবর্জন করেন” বলতে দুটি
ধারায় কামসমূহ পরিত্যাগ করেন, বিষ্কম্ভনরূপে (দমনরূপে) বা সমুচ্ছেদরূপে। কিরূপে বিষ্কম্ভনরূপে
কামসমূহ পরিবর্জন করেন? “কাম অস্থিকঙ্কাল সদৃশ স্বাদহীন” দর্শনকালে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম বহু সাধারণের মাংসপেশীতুল্য” দর্শনকালে
বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন; “কাম অনুদহনের
তৃণমশাল সদৃশ” দর্শনকালে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন;... এবং নৈবসংজ্ঞা-নাসংজ্ঞায়তন-সমাপত্তি
ভাবনাকালে বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিত্যাগ করেন। এভাবেই বিষ্কম্ভনরূপে কামসমূহ পরিবর্জন
করেন... এভাবেই সমুচ্ছেদরূপে কামসমূহ পরিবর্জন করেন। এ অর্থে কামসমূহ পরিবর্জন করেন।
“সেসব” বলতে (সেই) বস্তুকামসমূহ জ্ঞাত হয়ে, ক্লেশকামসমূহ ত্যাগ করে, পরিত্যাগ
করে, অপনোদন করে, ধ্বংস করে ও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে; কামচ্ছন্দ-নীবরণ ত্যাগ করে,
পরিত্যাগ করে, অপনোদন করে, ধ্বংস করে ও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে; ব্যাপাদ-নীবরণ... স্ত্যানমিদ্ধ-নীবরণ...
ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য-নীবরণ... এবং বিচিকিৎসা-নীবরণ ত্যাগ করে, পরিত্যাগ করে, অপনোদন করে,
ধ্বংস করে ও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে কামোঘ, ভবোঘ, দৃষ্টি-ওঘ এবং অবিদ্যা-ওঘ অতিক্রম
করেন, উত্তীর্ণ হন, পার হন, সমতিক্রম করেন এবং সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হন।
যেমন : মাল বোঝাইকারী ভারী নৌকা জল সরিয়ে, ছাড়িয়ে এবং ছিটিয়ে হালকা
নৌকার চেয়ে বেগবান গতিতে ও অপ্রতিরুদ্ধভাবে অপর পারে গমন করতে পারে, ঠিক এভাবেই বস্তুকামসমূহ
জ্ঞাত হয়ে, ক্লেশকামসমূহ ত্যাগ করে, পরিত্যাগ করে, অপনোদন করে, ধ্বংস করে ও সম্পূর্ণরূপে
ধ্বংস করে; কামচ্ছন্দ-নীবরণ... ব্যাপাদ-নীবরণ... স্ত্যানমিদ্ধ-নীবরণ... ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য-নীবরণ...
এবং বিচিকিৎসা-নীবরণ ত্যাগ করে, পরিত্যাগ করে, অপনোদন করে, ধ্বংস করে ও সম্পূর্ণরূপে
ধ্বংস করে দ্রুত, অবিলম্বে এবং সহজে পরপারে গমন করতে সক্ষম হন। অমৃত নির্বাণকে ‘পরপার’ বলা হয়, যা সেই সর্বসংস্কার উপশম, সমস্ত উপধির পরিত্যাগ, তৃষ্ণাক্ষয়,
বিরাগ, নিরোধ এবং নির্বাণ। “পরপারে গমন
করেন” অর্থে পরপারে গমন করেন, পারস্পর্শ করেন এবং পার সাক্ষাৎ করেন। “পারগূ” বলতে যে ব্যক্তি পরপারে গমনেচ্ছু তিনিই পারগূ; যিনি পরপারে গমন
করছেন তিনিই পারগূ; এবং যিনি পারগত হয়েছেন তিনিই পারগূ।
তাই ভগবান বলেছেন: ব্রাহ্মণ পরপারে তীর্ণ ও উত্তীর্ণ হয়ে স্থলে স্থিত হন। হে ভিক্ষুগণ, ‘ব্রাহ্মণ’ অর্হতের অধিবচন। তিনি অভিজ্ঞানপারগূ, পরিজ্ঞানপারগূ, প্রহানপারগূ, ভাবনাপারগূ, সাক্ষাৎকরণ-পারগূ এবং সমাপত্তিপারগূ। সর্বধর্মের অভিজ্ঞাপারগূ, সর্বদুঃখের পরিজ্ঞাপারগূ, সর্বক্লেশের প্রহানপারগূ, চারি আর্যমার্গের ভাবনাপারগূ, নিরোধের সাক্ষাৎকরণপারগূ এবং সর্বসমাপত্তির সমাপত্তিপারগূ। তিনি আর্যশীলে বশীপ্রাপ্ত, পারমীপ্রাপ্ত; আর্য-সমাধিতে বশীপ্রাপ্ত, পারমীপ্রাপ্ত; আর্যপ্রজ্ঞায় বশীপ্রাপ্ত, পারমীপ্রাপ্ত; আর্যবিমুক্তিতে বশীপ্রাপ্ত, পারমীপ্রাপ্ত। তিনি পারগত, পারপ্রাপ্ত, অন্তগত, অন্তপ্রাপ্ত, সীমাগত (কোটিগতো), সীমাপ্রাপ্ত, প্রান্তগত, প্রান্তপ্রাপ্ত, অবসানগত, অবসানপ্রাপ্ত, ত্রাণগত, ত্রাণপ্রাপ্ত, শরণগত, শরণপ্রাপ্ত, অভয়গত, অভয়প্রাপ্ত, অচ্যুতগত, অচ্যুতপ্রাপ্ত, নির্বাণগত, নির্বাণপ্রাপ্ত। তার আবাস উত্থিত বা ঊর্ধ্বগত, আচরণ পূর্ণ, ভ্রমণ সীমাপ্রাপ্ত, দিকসমাপ্ত, অভিপ্রায় সমাপ্ত, ব্রহ্মচর্য পালিত, উত্তম দৃষ্টিপ্রাপ্ত, ভাবিত মার্গ, ক্লেশ প্রহীন, কোপ প্রতিবিদ্ধ, নিরোধ সাক্ষাৎকৃত, দুঃখ পরিজ্ঞাত, সমুদয় প্রহীন, মার্গভাবিত, নিরোধ সাক্ষাৎকৃত, অভিজ্ঞেয় অভিজ্ঞাত, পরিজ্ঞেয় পরিজ্ঞাত, প্রহাতব্য প্রহীন, ভাবিতব্য ভাবিত, সাক্ষাতব্য সাক্ষাৎকৃত। তিনি বাধা-উৎক্ষিপ্ত, পরিখাসংকীর্ণ, তৃষ্ণাবিমুক্ত, বাধামুক্ত, আর্য, মানধ্বজ অবনত, ভারমুক্ত, বিসংযুক্ত, পঞ্চাঙ্গ বিপ্রহীন, ষড়ঙ্গ সমন্বিত, একারক্ষী, চার অবলম্বনপ্রাপ্ত, চার প্রকার মিথ্যা ধারণা বিদূরণকারী, অন্বেষণ ত্যাগকারী, অনাবিল সংকল্পী, প্রশান্ত কায়সম্পন্ন, সুবিমুক্ত চিত্তসম্পন্ন, সুবিমুক্ত প্রাজ্ঞ, পূর্ণতাপ্রাপ্ত, অর্হত্ত্বপ্রাপ্ত, উত্তম পুরুষ, পরম পুরুষ, পরম লাভী। তিনি সঞ্চয়ও করেন না, অ-সঞ্চয়ও করেন না; সঞ্চয় না করেই স্থিত থাকেন। তিনি ত্যাগও করেন না, গ্রহণও করেন না; ত্যাগ করেই স্থিত থাকেন। তিনি আসক্তও হন না, অনাসক্তও হন না; অনাসক্ত হয়েই স্থিত হন। তিনি নিজেকেও শোধিত করেন না, অপরকেও শোধিত করান না; শোধিত হয়েই স্থিত হন। অশৈক্ষ্য শীলস্কন্ধে সমন্নাগত হয়ে স্থিত হন। অশৈক্ষ্য সমাধিস্কন্ধে...অশৈক্ষ্য প্রজ্ঞাস্কন্ধে...অশৈক্ষ্য বিমুক্তিস্কন্ধে...অশৈক্ষ্য বিমুক্তি জ্ঞানদর্শন স্কন্ধে সমন্নাগত হয়ে স্থিত হন। তিনি সত্যকে সত্যরূপে জ্ঞাত হয়ে স্থিত হন। আসক্তিকে অতিক্রম করে স্থিত হন। ক্লেশাগ্নি ধ্বংস করে স্থিত হন, অপরিগমনে স্থিত হন, করণীয় সম্পন্ন করে স্থিত হন, মুক্তি প্রতিসেবন করে স্থিত হন, মৈত্রী পরিশুদ্ধিতে স্থিত হন, করুণা... মুদিতা... উপেক্ষা পরিশুদ্ধিতে স্থিত হন। অনন্ত পরিশুদ্ধিতে স্থিত হন, অনড় পরিশুদ্ধিতে স্থিত হন, বিমুক্ত হয়ে স্থিত হন, সন্তুষ্টিতে স্থিত হন, স্কন্ধসীমায় স্থিত হন, ধাতুসীমায় স্থিত হন, আয়তনসীমায় স্থিত হন, গতিসীমায় স্থিত হন, উৎপত্তিসীমায় স্থিত হন, প্রতিসন্ধিসীমায় স্থিত হন, অন্তিম আশ্রয়ে স্থিত হন, অন্তিম দেহধারী অর্হৎ। এটিই তার শেষ জন্ম, এটিই অন্তিম দেহ; তার জন্ম, মরণ, সংসার পুনর্জন্ম এসবের কিছুই নেই।
তাই ভগবান বলেছেন: তদ্ধেতু মানুষ সদা স্মৃতিমান হয়ে কামসমূহ পরিবর্জন করেন। (ভারী) নৌকা জল ছাড়িয়ে গমন করার ন্যায় পরপারে গমনেচ্ছু ব্যক্তি সেই সব (বস্তুকাম, ক্লেশকাম, পঞ্চনীবরণ) পরিত্যাগ করে স্রোত উত্তীর্ণ হন।
প্রথম কামসূত্র
বর্ণনা সমাপ্ত।